স্প্যানিশ ক্লাব এফসি বার্সেলোনা সভাপতি জোসেপ মারিয়া বার্তেমেওয়ের কাছে একবার এক ফুটবলারকে দলে ভেড়ানো নিয়ে বেশ আলোচনা হলো। কানাডিয়ান ডিফেন্ডার, খেলেন যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ সকারে। এই ফুটবলারকে কেনার প্রস্তাব শুনে নাক সিঁটকেছিলেন তিনি, শুধু তাই নয়, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যভরে করেছিলেন প্রত্যাখ্যানও!
সেই আলফনসো ডেভিসের পায়েই নিজেদের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম বাজে ম্যাচের সাক্ষী হয়েছিলো কাতালান জায়ান্ট এফসি বার্সেলোনা। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে যে ম্যাচে বায়ার্নের কাছে ৮-২ গোলের লজ্জায় ডুবেছিল মেসির দল, সেই ম্যাচে অসাধারণ খেলেছিলেন ডেভিস। বিশেষ করে দ্বিতীয়ার্ধে নেলসন সেমেদোকে বোকা বানিয়ে জসুয়া কিমিচকে দিয়ে যে গোলটি তিনি করিয়েছেন, সেটা দীর্ঘদিন চোখে লেগে থাকবে ফুটবলপ্রেমীদের।







































































































ডেভিসকে দলে ভেড়ানোর ব্যাপারে বার্সা রাজি না হলেও গত বছর সালে আলফনসো ডেভিসকে কিনে নিয়েছিল বায়ার্ন মিউনিখ। দুরন্ত গতির এই লেফট ব্যাক যেন বায়ার্নের ফুটবল দলে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে পিএসজির বিপক্ষেও অসাধারণ খেলা উপহার দিয়েছিলেন তিনি।
বয়স তার মাত্র ১৯। এই বয়সেই ফুটবল দুনিয়া কাঁপানোর বার্তা দিয়ে দিলেন তিনি। অথচ জাতিতে নিগ্রো এবং চিতার মতো ক্ষিপ্র এই ফুটবলারের ইউরোপের শীর্ষে উঠে আসার গল্পটা কিন্তু এত সহজ নয়।








































































































































ফুল বিছানো ছিল না তার এ পর্যন্ত উঠে আসার পেছনে। প্রতিটি পদক্ষেপেই তিনি পাড়ি দিয়ে এসেছেন কাঁটার পাহাড়। লাইবেরিয়ান বাবা-মায়ের ঘরে একটি শরণার্থী ক্যাম্পে জন্মগ্রহণ করেন আলফনসো ডেভিস।
বাবা দেবেয়াহ এবং মা ভিক্টোরিয়া তার জন্মের আগেই লাইবেরিয়ার রাজধানী মনরোভিয়া ত্যাগ করেছিলেন, সেখানে গৃহযুদ্ধের দাবানল জ্বলে ওঠার পর। আশ্রয় নিয়েছিলেন ঘানার শরণার্থী ক্যাম্পে।








































































































































ডেভিসের বাবা দেবেয়াহ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “সেখানে (মনরোভিয়া) বেঁচে থাকতে হলে আপনাতে হাতে অস্ত্র তুলে নিতেই হবে। না হলে উপায় নেই। অথচ, আমাদের মোটেও ইচ্ছা ছিল না হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে মানুষের বুকে গুলি করতে। পুরো জায়গাটা ছিল ভয়ানক। খাবার খেতেও আপনাকে যেতে হতো লাশের সারির ওপর দিয়ে।”
দেবেয়াহ এবং ভিক্টোরিয়া ঘানার শরণার্থী ক্যাম্পের জীবন শেষ করেন দেশটির রাজধানী আক্রার পশ্চিমাংশে অবস্থিত বুদুবুরাম থেকে। শরণার্থী জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ভিক্টোরিয়া বলেন, “সেখানে আমাদের জীবনটা যেন একটি কন্টেইনারে বন্দীর মত। যে কন্টেইনারের তালা বন্ধ করে চাবিটা কোথাও ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছিল। সেখান থেকে আর বের হওয়ার কোনো উপায় ছিল না।”








































































































































সৌভাগ্য আলফনসো ডেভিসের। তার মা-বাবা কোনোভাবে সেই শরণার্থী শিবিরের বন্দীদশা থেকে বের হতে পেরেছিলেন এবং পাড়ি জমিয়েছেন কানাডায়। দেশটির এডমন্টনে কিভাবে দেবেয়াহ এবং তার পরিবার গেলো, সে অভিজ্ঞতা নিয়ে ডেভিস বলেন, “আমি এ সম্পর্কে আসলে কিছুই জানি না। এমনকি এখানকার কাউকে চিনি না। শুধু বলতে পারতাম, আমি ভালো আছি।”
২০০৬ সালে এডমন্টনে স্কুলে যাওয়া শুরু করেন ডেভিস। একই সঙ্গে সেখানকার স্কুল ফুটবলে নাম লেখান এবং খুব অল্পদিনেই নিজের জাত চেনাতে সক্ষম হন। এডমন্টনে ফ্রি ফুটি নামে একটি সংগঠন প্রায় চার হাজার বাস্তুহারা কিংবা বস্তির শিশুকে ফুটবল খেলা শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছিল পুরোপুরি ফ্রি’তে।








































































































































ফ্রি ফুটির প্রধান নির্বাহী টিম অ্যাডামস বলেন, “আলফনসো আসলে একটি উদাহরণ তৈরি করেছিল। সবকিছু ঠিক থাকলে যে কোনো শিশু ভালোভাবে বেড়ে ওঠে এবং তার প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটাতে পারে, সেটার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সে। যদিও এই শিশুটির মধ্যে আমরা বিশেষ কিছু দেখেছিলাম।”
এই টিম অ্যাডামসই ডেভিসের জন্য সেন্ট নিকোলাস ক্যাথলিক স্কুলের ফুটবল শিক্ষক মার্কো বোসিওর কাছে অনুরোধ করেন, সেখানকার ফুটবল একাডেমিতে তাকে প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দেয়ার জন্য। বোসিও বলেন, “অনেক উঁচুতে যাওয়ার জন্য আমরা ডেভিসের মধ্যে খুব শক্তিশালী মানসিকতা দেখতে পেয়েছিলাম। আমি বিষয়টা ফোনে জানিয়েছিলাম (হোয়াইটক্যাপসকে)। তারা ডেভিসকে ট্রায়ালের জন্য ডাকে এবং সেখানে তারা দেখে, যেটা আমি ডেভিসের মধ্যে দেখতে পেয়েছিলাম।”








































































































































১৪ বছর বয়সেই ডেভিস মা-বাবাকে ছেড়ে ১ হাজার কিলোমিটার দুরে ভ্যাঙ্কুবারে চলে যান। এমনকি বিষয়টা তার মা-বাবাও জানতেন না। তার মা ভিক্টোরিয়া বলেন, “আমি খুব ভয়ে ছিলাম। আমি জানতাম কিছু তরুণ মানুষ কিছু একটা করছে। কী করছে তা জানতাম না। কিন্তু আমি চাইতাম না, ডেভিস সেটা করুক। আমি চেয়েছিলাম, তার বয়স ১৬ কিংবা ১৭ হোক। এরপর সে ওসব কিছুতে জড়াক। কিন্তু সে আমাকে ওয়াদা দিয়েছিল, সে কখনও বদলে যাবে না। আগের মতই থাকবে এবং শেষ পর্যন্ত সে আমাদেরকে গর্বিত করেছে।”
মাত্র ১৫ বছর ৮ মাস বয়সেই হোয়াইটক্যাপের হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল লিগ এমএলএসে অভিষেক হয় ডেভিসের। সে সঙ্গে একটি রেকর্ডও গড়ে ফেলেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের ঘরোয়া ফুটবল ইতিহাসে তিনিই প্রথম ফুটবলার, যার জন্ম হয়েছিলো একবিংশ শতাব্দীতে। এর আগে এমএলএস লিগে যারা খেলেছিলেন, তাদের সবারই জন্ম ২০০০ সালের আগে।








































































































































২০১৭ সালে কানাডার নাগরকিত্ব লাভ করেন আলফনসো ডেভিস। একইসঙ্গে কানাডা জাতীয় দলে খেলার উপযুক্ত হয়ে যান তিনি। এর এক সপ্তাহ পরই কানাডা দলে ডাক পান তিনি। ২০১৭ সালের গোল্ড কাপে কানাডা জাতীয় দলে উইঙ্গার হিসেবে খেলেন এবং ফ্রেঞ্চ গায়ানার বিপক্ষে গোল করে কানাডিয়ান ফুটবলের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে স্কোর করার রেকর্ড গড়েন তিনি।
২০১৮ সালেই বায়ার্ন মিউনিখ ডেভিসকে ডেকে নেয় এবং মাত্র ১৮ বছর বয়সেই তিনি গিয়ে যোগ দেন জার্মান জায়ান্টদের শিবিরে। বায়ার্নের স্পোর্টিং ডিরেক্টর হাসান সালিহামিডজিক বলেন, “আমরা তাকে দলে এনেছি, কারণ তাকে দেখেছিলাম। তাকে দেখে আমাদের মনে হয়েছে, বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে সে অন্যতম সেরা একজন ফুটবলার।”








































































































































২০১৯ সালের জানুয়ারিতে প্রথম বায়ার্নের জার্সিতে মাঠে নামেন তিনি। এরপরই ইউরোপিয়ান ফুটবলে নিজের নামকে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত করে তুলছেন আলফনসো ডেভিস।
তথ্যসূত্র: মার্কা